পোস্টমর্টেমকে বাংলায় কেন ‘ময়নাতদন্ত’ বলা হয়?

ময়নাতদন্ত

Best Asked on October 16, 2020 in Solution.
Add Comment
  • 1 Answer(s)

    এই প্রশ্নটা আমার মাথাতেও ঘুরতো ছোটোবেলায়। ময়নাতদন্তই কেন বলে, কাক তদন্ত কেন বলে না, পাখি তদন্ত বলে আদৌ কিছু আছে কিনা- ইত্যাকার নানাবিধ প্রশ্ন। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম বোধহয়, কিন্তু কি উত্তর পেয়েছিলুম, তা আজ আর মনে নেই। এখন এই প্রশ্নটা দেখে আবার চড়াৎ করে ঘিলুতে তড়িৎ প্রবাহিত হল, কৌতূহলের অসুখটা মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠলো।

    পোস্টমর্টেমের বাংলা ‘ময়নাতদন্ত’ই কেন, এ ব্যাপারে প্রচলিত আছে একখানা বেশ ‘রসালো’ ব্যাখ্যা (বাঙালির যা স্বভাব আর কি)। কিন্তু সে ব্যাখ্যাকে একপ্রকার ‘মিথ’ই বলা চলে, অন্তত আমার মতে। যদিও সেই ব্যাখ্যাটা দেওয়ার পরেই আমি প্রকৃত কারণের বিবরণে যাবো।

    কি বলা হয় এই ব্যাখ্যায়?

    মজার ব্যাপারটা হল এই ব্যাখ্যায় ময়নাতদন্ত বা পোস্ট মর্টেমের সাথে ময়না পাখির সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে,

    সত্যিকার অর্থেই ময়না পাখির সঙ্গে পোস্টমর্টেমের একটি সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। ময়না পাখির গায়ের রঙ কালো ধরনের এবং ঠোঁটের রঙ হলুদ হয়ে থাকে। ময়না প্রায় ৩ থেকে ১৩টি স্বরে ডাকতে পারে। গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে অন্ধকারে ময়না পাখির দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অন্ধকারের মাঝে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তবে অভিজ্ঞ মানুষেরা ময়নার ডাক শুনেই বুঝতে পারেন, ওটা ময়না পাখির ডাক।

    অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ময়না পাখিকে যেমন শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর শুনেই আবিষ্কার করা সম্ভব হয়, ঠিক তেমনি পোস্টমর্টেমের মাধ্যমেও কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর অজানা রহস্য বা অন্ধকারে থাকা কারণসমূহ সূত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। সামান্য সূত্র প্রয়োগ করে শেষপর্যন্ত আবিষ্কার করা যায় নানা ধরনের অজানা রহস্য। অনেক সময়ে সেই তথ্যসূত্র ধরেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় প্রকৃত অপরাধীদের। অর্থাৎ ময়না পাখির মতো পোস্টমর্টেমও অন্ধকারের নানা রহস্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। আর এই রহস্যকে কেন্দ্র করেই পোস্টমর্টেম পরিভাষাটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ময়নাতদন্ত।[1]

    শুনতে ভারি আকর্ষণীয় ঠেকছে, তাইনা? আমারও মনে হয়েছিল, বিশ্বাস করুন। কিন্তু, খটকা! এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে যে! বাংলা ভাষার কোনো ভারিক্কি শব্দের ব্যুৎপত্তি এত সাদামাটা হবে? উঁহু, কেন জানিনা সন্দেহ হচ্ছিল। তার ওপর সন্দেহের আরো বড় একটা কারণ ছিল। ‘ময়না’ পাখির নাম তো বিশেষ্যপদ, কিন্তু ‘ময়নাতদন্ত’এর ‘ময়না’ কে ‘তদন্ত’ বিশেষ্যের সাপেক্ষে বিশেষণ বলেই মনে হচ্ছে। মানে, ‘তদন্ত’ বিশেষ্যকে ‘ময়না’ বিশেষিত করছে।

    সন্দেহ দূর করার জন্য সংসদের বাংলা অভিধানখানা খুলে বসলুম। অতঃপর, সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।

    কি তবে ‘প্রকৃত ব্যাখ্যা’?

    অভিধান বলছে, ‘ময়না’ শব্দের তিনরকম অর্থ হতে পারে। এদের মধ্যে দুটি শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হয় বিশেষ্যপদ হিসেবে, আর একটি শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে বিশেষণরূপে।

    প্রথম ‘ময়না’র অর্থ : হলদে ঠোঁটবিশিষ্ট কালো রঙের সুকণ্ঠী পাখিবিশেষ। যার সংস্কৃত পরিভাষা হল: মদনিকা।

    দ্বিতীয় ‘ময়না’র অর্থ : ডাকিনী বা খল স্বভাবা নারী। এই ‘ময়না’ শব্দটি এসেছে রাজা মানিকচন্দ্রের জাদুকরী স্ত্রী ময়নামতীর নাম থেকে।

    কাজেই বাক্যে ব্যবহারের দিক থেকে এই দুটি ‘ময়না’ ই বিশেষ্যপদ।

    তাহলে, বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় যে ‘ময়না’ তার উৎস কোথা থেকে? আরবি শব্দ ‘মুআয়্নহ্’ এর অর্থ হল: ‘অনুসন্ধান ও প্রত্যক্ষ পরিদর্শন সহকারে কৃত ‘ । অভিধান অনুসারে এই শব্দ থেকেই কিছুটা বিবর্তিত হয়ে বাংলায় ‘ময়না’ শব্দটির উৎপত্তি। ফার্সি, উর্দু ভাষাতে তো সম্ভবত এখনও ‘মুআয়্নহ্’ শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত। তাই, বাক্যে ‘ময়না’ বিশেষণের পর ‘তদন্ত’ বিশেষ্য বসে এর অর্থকে সম্পূর্ণতা দান করে – ‘অনুসন্ধান ও প্রত্যক্ষ পরিদর্শনে করা তদন্ত’।

    এই শব্দের এতটা ‘মুআয়্নহ্’ করার পর, দ্বিতীয় বিবরণখানাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হল আমার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আন্তর্জালিক জগতে সর্বত্র সেই প্রথম ব্যাখ্যার ছড়াছড়ি। আমরা আমজনতা, আয়েশ করে গাঁজাখুরি গল্প খেতে যে কতটা প্রফুল্লবোধ করি, সেটা নিয়ে তো কোনো দ্বিমত থাকতেই পারে না। সেজন্যই হয়তো একের পর এক তথাকথিত বিশ্বাসযোগ্য বাংলা সংবাদমাধ্যম কিংবা বাংলা ব্লগের ঠিকানাতেও ‘ময়না পাখির গল্প’ পেলাম, তাও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ও নিশ্চয়তার সাথে। যাকগে যাক, কে কোন ব্যাখ্যা বিশ্বাস করবেন, সেটা অবশ্যই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিবেচনাবোধের ব্যাপার। হতেই পারে, প্রথম ব্যাখ্যাই আপনার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হল, এতে দোষের কি আছে? আমি শুধু আমার অভিমত জানালুম মাত্র।

    পরিশেষে, এটাই বলবো, বাংলা ব্যাকরণ এবং বিবিধ শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় বিষয়ে আমার জ্ঞানভাণ্ডার একেবারে শুন্যের কাছাকাছি। কাজেই, ভুল করাটাই আমার কাছ থেকে প্রত্যাশিত। বাংলা কোরাতে এই বিষয়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্বের অভাব নেই। তাদের কাছে অধমের অনুরোধ রইলো, আমার উত্তরের যাবতীয় ভুলত্রুটি সম্বন্ধে অবগত করিয়ে দিয়ে আমায় বাধিত করবেন।

    ধন্যবাদ 🙂

    Better Answered on October 16, 2020.
    Add Comment
  • Your Answer

    By posting your answer, you agree to the privacy policy and terms of service.